Rubik’s Cube পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পাজেল

রুবিকস কিউব (ইংরেজি: Rubik’s Cube) একটি ঘনাকার যান্ত্রিক ধাঁধা। ১৯৭৪ সালে হাঙ্গেরীয় ভাস্কর ও স্থাপত্যের অধ্যাপক এর্নো রুবিক এটি উদ্ভাবন করেন। রুবিক নিজে এর নাম দিয়েছিলেন ম্যাজিক কিউব (Magic Cube), কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে Ideal Toys নামের এক খেলনা প্রস্তুতকারী কোম্পানী এর নাম দেয় রুবিক্‌স কিউব অর্থাৎ রুবিকের ঘনক।

রুবিক্‌স কিউব সাধারণত ৩x৩x৩ মাত্রাবিশিষ্ট ঘনকাকৃতির হয়ে থাকে। ঘনকের প্রতিটি তল আবার ৯টি করে বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত থাকে। এই ছোট বর্গক্ষেত্রগুলি ৬টি ভিন্ন রঙের যেকোন একটি রঙে রাঙানো থাকে। রুবিক্‌স কিউবের যান্ত্রিক কৌশল এমন হয় যে, ঘনকের যেকোন একটি তলের সবগুলো বর্গকে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান পরিবর্তন না করেই একত্রে ঘোরানো সম্ভব। এভাবে ঘুরিয়ে রুবিকস্‌ কিউবকে বিভিন্ন রকম অবস্থা বা কনফিগারেশনে (configuration) নিয়ে যাওয়া সম্ভব। রুবিকস্‌ কিউবের বিভিন্ন রকম সংষ্করণ আছে, তার মধ্যে ২x২x২ মাত্রার পকেট কিউব (Pocket Cube), ৪x৪x৪ মাত্রার রুবিক্‌স রিভেঞ্জ (Rubik’s Revenge) এবং ৫x৫x৫ মাত্রার প্রফেসর্‌স কিউব (Professor’s cube) উল্লেখযোগ্য।

সমাধানকৃত অবস্থায় রুবিক্‌স কিউবের একটি তলে সবগুলো বর্গ একই রঙের হয়। ঘনকের ৬টি তলের প্রত্যেকটিতে একটি করে ভিন্ন রঙ থাকে। মজার ব্যাপার হলো এর একসাথে ৩টি তলের বেশি দেখা যায় না । সমাধানকৃত একটি রুবিকস্‌ কিউবের বিভিন্ন তলকে ইচ্ছামত ঘুরিয়ে এলোমেলো করা যায়। এরকম এলোমেলো অবস্থা বা কনফিগারেশন থেকে সমাধানকৃত অবস্থায় নিয়ে আসাই এই যান্ত্রিক ধাঁধাঁটির লক্ষ্য।

সময়টা ছিল ১৯৭৪ সাল। এর্নো রুবিকের বয়স তখন মাত্র ২৯। তিনি যে রুমে থাকতেন সেই রুমটা ছিল এলোমেলো। রুবিক বিভিন্ন আকারের জিনিস নিয়ে খেলতে পছন্দ করতেন। যেখানে থাকতেন সেখানে প্রায়ই কাঠের টুকরো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো। একদিন খেলার বশেই কাঠের টুকরোগুলোকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগালেন।

তারপর বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক আর ইলাস্টিক স্প্রিং দিয়ে বানিয়ে নিলেন অদ্ভুত এক জিনিস। অনেকটা কৌতূহলবশতই ছোট কাঠের ব্লকগুলোকে এলোমেলোভাবে ঘোরাতে লাগলেন তিনি। কিছুক্ষণ ঘোরানোর পর যখন রঙগুলো এলোমেলো হয়ে যায় তখন তার দেখতে খুব ভালই লাগছিলো। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত রুবিক বোঝতেই পারেননি যে, তিনি কী বানিয়ে ফেলেছেন যতক্ষণ না তিনি এটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে অনেকটা এলোমেলো করে ফেলেছিলেন। অবাক হয়েই তিনি লক্ষ্য করলেন, এখন আর তিনি রঙগুলোকে মিলাতে পারছেন না। রুবিক তার একটি অপ্রকাশিত স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ Quoted in Discovermagazine এ বলেন,

“এটা এমন যে আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা লিখার দিকে তাকিয়ে আছি যেটাতে একটা গোপন কোড লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু আমার এ ভেবেই ভালো লাগছিল যে, আমি নিজেই এই কোডের স্রষ্টা। যদিও আমি এটা পড়তে পারছিলাম না। এটা সত্যিই অসাধারণ একটি মুহুর্ত যেটা আমি সহজে মেনে নিতে পারছিলাম না।”

আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর্নো রুবিকের কোনো ধারণাই ছিল না যে কিভাবে তিনি এটা সমাধান করবেন। তিনি মনে মনে সন্দেহ করতেন যে, আসলেই কি কেউ এটা সমাধান করতে পারবে? কারণ গণিতের সম্ভাব্যতার সূত্র কাজে লাগিয়ে বলা যায় যে, একটি ৩x৩x৩ আকারের রুবিক’স কিউবের প্রায় ৪৩,২৫২,০০৩,২৭৪,৪৮৯,৮৫৬,০০০ ধরনের সম্ভাব্য কনফিগারেশন রয়েছে। এর মধ্যে শুধু একটি কনফিগারেশনেই রুবিক’স কিউবের সবগুলো তলে রঙগুলো মিলবে। এর্নো রুবিক তো ধরেই নিয়েছিলেন যে, কেউ হয়তো এটি আর মেলাতেই পারবে না! তার নিজের এই রুবিকটি সমাধান করতে প্রায় এক মাসের মতো লেগেছিল।

রুবিক তার “ম্যাজিক কিউব” আবিষ্কার করেন ১৯৭৪ সালে এবং ১৯৭৫ সালে হাঙ্গেরীয় প্যাটেন্ট লাভ করেন কিন্তু তখন আন্তর্জাতিক প্যাটেন্টটি হয়নি। ১৯৭৭ সালের শেষদিকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে রুবিক কিউব উৎপাদন করা হয় এবং বুদাপেস্ট এর খেলনার দোকানগুলোতে বিক্রয় করা হয়। ম্যাজিক কিউব তৈরি করা হত প্লাস্টিক দিয়ে এবং ছোট ছোট খণ্ডগুলো একে অপরের সাথে আটকে থাকতো যান্ত্রিক উপায়ে যা নিকোলাসের চুম্বক ডিজাইন হতে তুলনামূলক কম দাম ছিল। ম্যাজিক কিউব পশ্চিমা বিশ্বে বাজারজাত করার জন্য আইডিয়াল টয় চুক্তি করে এবং ১৯৮০ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এক খেলনা প্রদর্শনীতে ধাঁধাঁটির অভিষেক ঘটে পশ্চিমা বিশ্বে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ম্যাজিক কিউবের পরিচয় ঘটার পর পশ্চিমের খেলনার দোকানসমূহে বিক্রয় সাময়িক স্থগিত করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমের নিরাপত্তা ও মোড়ক সম্পর্কিত বিধিনিষেধ অনুযায়ী ম্যাজিক কিউবকে নতুন আঙ্গিক দেওয়া। এতদসঙ্গে এটির ওজন হালকা করা হয় এবং আইডিয়েল টয় সিদ্ধান্ত নেয় নাম পরিবর্তনের। প্রথমে “দ্যা গোল্ডেন নট” এবং “ইনকা গোল্ড” নাম দু’টি প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু কোম্পানির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এর নাম হয় “Rubik’s Cube” বা “রুবিক’স কিউব”। নতুন আঙ্গিকে নতুন নাম নিয়ে হাঙ্গেরী থেকে রুবিকের কিউবের প্রথম চালানটি রপ্তানি করা হয় ১৯৮০ সালের মে মাসে।

১৯৮০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ১০০ মিলিয়নের বেশি রুবিক্স কিউব বিক্রি হয়।[৫] ১৯৮০ এবং ১৯৮১ সালে দুই দফায় এটি বিএটিআর টয় অব দ্যা ইয়ার (British Association of Toy Retailers) পুরস্কার জয় করে নেয়। আইডিয়া টয় ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত রুবিক্স কিউব নিউজলেটার নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে।

১৯৮৩ সালে শনিবার সকালে রুবিক, দ্যা আমেইজিং কিউব (Rubik, the Amazing Cube) নামে রুবিক্স কিউবের উপরে ভিত্তি করে একটি কার্টুন সিরিজ প্রচারিত হত। এ সিরিজটি এক মৌসুম প্রচারিত হয়েছিল।

রুবিক্স কিউবের কিছুদিনের মধ্যেই রুবিক এবং অন্যান্য জায়গা থেকে একই রকমের আরও কিছু ধাঁধা বের হয়। যেমন রুবিক্স রিভেঞ্জ (Rubik’s Revenge), রুবিক্স কিউবের একটি ৪x৪x৪ সংস্করণ। আরও ছিল ২x২x২, ৫x৫x৫ কিউব (যাদের নাম যথাক্রমে পকেট কিউব এবং প্রফেসরস্‌ কিউব) এবং অন্য আকারের ধাঁধা যেমন পাইরামিংক্স (Pyraminx), একটি টেট্রাহেড্রোন।

২০০৫ এর মে মাসে গ্রিক আবিষ্কারক প্যানাগিওটিস ভার্দেস ৬x৬x৬ রুবিক্স কিউব তৈরি করেন; মে ২৩ ২০০৬ সালে রুবিক্স কিউব সমাধানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রাঙ্ক মরিস এই সংস্করণটি পরীক্ষা করেন। তিনি পূর্বে ৩x৩x৩ সমাধান করেছেন ১৫ সেকেন্ডে, ৪x৪x৪ সমাধান করেছেন ১ মিনিট ১০সেকেন্ডে এবং ৫x৫x৫ সমাধান করেছেন ১ মিনিট ৪৬.১ সেকেন্ডে। ৬x৬x৬ সমাধান করতে তিনি সময় নেন ৫ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড। মরিস নিজে আবিষ্কারককে ধন্যবাদ জানান এবং উৎসাহের সাথে জানান যে যত বেশি বড় (সংখ্যা) কিউব তত বেশি আনন্দ। জুলাই ২০০৬ সালে ভার্দের সফলভাবে ৭x৭x৭ তৈরি করেন এবং অক্টোবর ২৭ ২০০৬ সালে মরিসের এ সংস্করণটি পরীক্ষা করার একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ হয়। তিনি এ কিউব সমাধান করেন ৬ মিনিট ২৯.৩১ সেকেন্ড।

১৯৮১ সালে প্যাট্রিক বোজার্ট নামের ইংল্যান্ডের বার বছরের এক স্কুল বালক ইউ ক্যান ডু দ্যা কিউব (You Can Do the Cube) নামক এক বইতে কিউব সমাধানের জন্য তার নিজস্ব এক সমাধানের কথা প্রকাশ করে। ঐ বই সতের টি সংস্করণ বিশ্ব ব্যপী ১.৫ মিলিওনেরও বেশি কপি বিক্রি হয় এবং বইটি দ্যা টাইমস্‌ (The Times) এ এক নম্বর বইয়ে পরিণত হয়।

 

 

১৯ মে, ২০১৪ সালে রুবিক’স কিউবের ৪০তম বার্ষিকীতে গুগল একটি ইন্টার‍্যাক্টিভ ডুডল তৈরি করে রুবিক’স কিউবের, যেখানে ব্যবহারকারীরা এর বিভিন্ন অংশ নাড়িয়ে মোবাইল দিয়েই রুবিক’স কিউব সমাধান করতে পারবেন। এভাবেই রুবিক’স কিউব প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের উপর প্রভাব ফেলে চলেছে। এখনো অনেক গবেষকেই বাচ্চাদেরকে খেলনা হিসেবে রুবিক’স কিউব দিতে বাবা মা-কে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

কারণ রুবিক’স কিউব সমাধান করা শিশুদের স্মৃতিশক্তি, ধৈর্যশক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এমনকি, এটি বাচ্চাদের প্রবলেম সলভিং এর দক্ষতাও বাড়িয়ে দেয় যা খুবই প্রয়োজনীয় বাচ্চাদের মেধার বিকাশের জন্য। তবে যেকোনো কিছুরই যেমন ভালো দিক থাকে তেমনি খারাপ দিকও থাকতে পারে। কোনো কিছুরই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আসতে পারে কিছু ক্ষতিকর সম্ভাবনার। রুবিক’স কিউবও মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে হতে পারে রুবিক্স রিস্ট (Rubik’s wrist), কিউবিস্ট থাম্ব (Cubist’s Thumb) সহ কিছু ক্ষতিকর শারীরিক সমস্যা, যেখানে রোগীর হাতের কব্জি এবং বৃদ্ধাঙ্গুলিতে দেখা দেয় প্রচন্ড রকমের ব্যথা। তাই বাবা মায়েদেরও উচিত সন্তানদের এ বিষয়টি খেয়াল রাখা।

এর্নো রুবিকের সৃজনশীল মানসিকতা আর ডিজাইনের প্রতি তার অধীর ভাল লাগাই হয়তো আমাদেরকে এনে দিয়েছে আজকের এই রুবিক’স কিউব যা এখনো আমাদের অনেক তরুণ তরুণীর হাতে জায়গা করে নিয়েছে। তাই আমাদের উচিত শিশুদেরকে এমন সব খেলনা দিয়ে খেলতে দেয়া যাতে তাদের মেধার বিকাশ হয়।

(Collected)

 

 

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    Main Menu